এই লেখাতে সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় ফটোগ্রাফির কিছৃ ধরণ (বা টেকনিক) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যারা প্রোট্রেট ফটোগ্রাফিতে নিজের দক্ষতা আরও ক্ষুরধার করতে বদ্ধ পরিকর; বা আরও সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি করতে চাচ্ছেন, বা আরও শার্প ক্লোজ-আপ (ম্যাক্রো ফটোগ্রাফিও হতে পারে) ফটো কিভাবে নেয়া যায় জানতে চাচ্ছেন, বা তাক লাগানো ও ব্যতিক্রমী স্ট্রিট ফটোগ্রাফিতে হাত পাকাতে তক্কে-তক্কে আছেন –
সূচীপত্র
টিপ ১. সাবজেক্টের চোখে ফোকাস করুন
প্রোট্রেট ছবিতে সাবজেক্টের চোখ শার্প থাকতে হবে। আর এ জন্য চোখে ফোকাস করতে হবে। “চোখ শার্প না থাকলেও চলবে” এ ভাবে কেউ যদি ছবি তুলতে বলে, তবে সেটা ভিন্ন কথা। ক্যামেরার ভাষায় একে স্পট মিটারিং বলে। ক্যামেরার AF point ম্যানুয়ালি সাবজেক্টের ডান বা বাম চোখের উপরে সেট করব, অথবা, সেন্টার ফোকাস পয়েন্ট ব্যবহার করে সাবজেক্টের চোখে ফোকাস লক করতে হবে। তারপর, সাটার রিলিজ বাটন হাফ-প্রেস করে এক্সপোজার লক করব। ক্যামেরা রিকম্পোজ (recompose) করে ফ্রেম ঠিক করব এবং শট নিব।
টিপ ২. স্ট্যান্ডার্ড বা টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করুন
এনভার্নমেন্টাল পোট্রেটে (environmental portrait) ব্যবহারের জন্য আদর্শ লেন্স হল ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স; এখানে সাবজেক্টকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে মিলিয়ে ছবিকে ফ্রেম করা হয়। তবে, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স ব্যবহারে সাবজেক্টের কাছে থেকে ছবি তুললে ডিসটরশন সৃষ্টি হয়; এতে ছবিতে সাবজেক্টের চেহারার বিকৃতি ঘটে যা দেখে অস্বস্তিকর মনে হতে পারে।
এই কারণে, পোট্রেট শটের জন্য ভাল অপশন হল, স্টান্ডার্ড বা শর্ট টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করা।
ফুলফ্রেম ক্যামেরার জন্য ক্ল্যাসিক পোট্রেট ফোকাল লেন্থ হল, 50mm ও 85mm লেন্স এবং 70-200mm টেলিফটো জুম লেন্স।
এই লেন্সগুলো সবচেয়ে বেশী ন্যাচারাল ও ডিসটর্শনমুক্ত ছবি প্রদান করে।
টিপ ৩. অ্যাপারচার প্রায়োরিটি মুড ব্যবহার করুন
অ্যাপারচার প্রায়োরিটি মুড ব্যবহার করে খুব সহজেই ক্যামেরার অ্যাপারচার নিয়ন্ত্রন করা যায়। আর, ডেপথ অব ফিল্ড নিয়ন্ত্রন করে এই অ্যাপারচার।
ফাস্ট প্রাইম লেন্স, যেমন 50mm f/1.4 বা 85mm f/1.2 – এগুলোতে থাকা অনেক বড় অ্যাপারচার দিয়ে খুব অগভীর ডেপথ অব ফিল্ড (shallow depth of field) তৈরী করা যায়। এগুলো দিয়ে সাবজেক্টের পিছনে মোলায়েম, মসৃন বোকেহ ব্লার তৈরী করে ছবিকে প্রফেশনাল চেহারা এনে দেয়।
এই রকম পাতলা লাইনের শার্পনেস পেলে কার না ভাল লাগে! কিন্তু, এর জন্য প্রয়োজন হবে, দক্ষ হাতে সাবজেক্টের একেবারে সঠিক অংশে ফোকাস করার সক্ষমতা। সঠিকভাবে সাবজেক্টের চোখে ফোকাস না করতে পারলে পুরো ফ্রেমটাই সফট মনে হবে।
টিপ ৪. জানালার আলোকে (window light) ব্যবহার করা
ছোট করে শুরু করুন। বাসাতেই অ্যামেইজিং পোট্রেট ছবি তুলতে বাসাতে বিপুল ব্যয়ের বিশাল হোম স্টুডিও খুলবার প্রয়োজন নেই। জানালা দিয়ে আসা ন্যাচারাল লাইট আর রিফলেক্টর দিয়েই স্টানিং পোট্রেট ছবি উঠানো যায়। এই সেট-আপের জন্য খুব বেশী খরচ করার প্রয়োজন নাই।
আপনার মডেলকে জানালার ধারে একটা সুবিধাজনক অ্যাঙ্গেলে পোজ নিয়ে দাঁড়াতে বলুন; খেয়াল করুন, সাবজেক্টে এমন কোন শ্যাডো আছে কিনা যার কারণে ঐ অংশে অতিরিক্ত কালো দেখাচ্ছে; এমন থাকলে সাদা বা সিলভার রিফলেক্টর ব্যবহার করে তা দূর করুন। সাদা থেকে সিলভারের প্রতিফলিত আলো সাবজেক্টের মুখে শার্প একটা ভাব নিয়ে আসে; যদিও পার্থক্যটা তেমন বেশী না।
যে স্পটে পোট্রেট শুট করছেন তার পারিপার্শ্বিকে থাকা রঙ আপনার ফ্রেমের থাকা সাবজেক্টের উপরে ছোপ-ছোপ রঙ (color cast) নিয়ে আসতে পারে। শট নেয়ার আগে ভিউফাইন্ডারে ভাল করে দেখে নিবেন। সবুজ লনে শুট করলে ফ্রেমে সবুজ রঙ লেপ্টে দিতে পারে। আবার সন্ধ্যার আগে কার্পেট থেকে ঠিকরে আসা রঙ থেকে ফ্রেমে একটা ওয়ার্ম (warm) ভাব নিয়ে আসে।
টিপ ৫. হাই-কি পোট্রেট (High-key portrait)
ইচ্ছাকৃতভাবে ওভার-এক্সপোজ করে ছবিতে হাই-কি ইফেক্ট দিয়ে শট নিলে ছবিতে বেশ-উজ্জ্বল ও কমনীয় ভাব নিয়ে আসা যায়। এমন শটে শিশু ও তরুণীদের ছবি মোহনীয়ভাবে ফুটে উঠে।
এই শটের ট্রিক হল, শট নেয়ার সময় ক্যামেরাতে হাইলাইট এরিয়ার পিক্সেল নষ্ট করা যাবে না। পরবর্তীতে ছবিকে ইমেজ এডিটিং সফটওয়্যার দিয়ে ব্রাইট করে নেয়া হয়।
“র” (RAW) মুডে ছবি তুললে ছবির প্রতিটা পিক্সেলের পূর্ণ টোনাল রেঞ্জের তথ্য জমা থাকে; যা দিয়ে এডিটিং এর সময় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাওয়া যায়। নি:সন্দেহে “র” মুডের ছবি জেপেগ (jpeg) থেকে সবসময়ই ভাল।
টিপ ৬. বেবি পোট্রেট
বেবিদের পোট্রেট নেয়ার সময় তাদের লাইটিং এর জন্য ন্যাচারাল লাইট সোর্সের ব্যবহার করাটাই বেস্ট অপশন। ফ্ল্যাশ লাইটের জোরালো আলো বরং তাদের ভয় পাইয়ে দিবে।
জানালার আলোতে তাদের বসিয়ে প্রয়োজনীয় অ্যাঙ্গেল থেকে রিফলেক্টর দিয়ে আলো প্রতিফলিত করে শ্যাডো দূর করুন।
যত বেশী আলো দিয়ে সাবজেক্টকে আলোকিত করা যাবে, তত কম ISO দিয়ে ছবির শট নেয়া যাবে। কম ISO এর ব্যবহার ঝকঝকে ছবির নিশ্চয়তা দেয়।
ফটো সেশনের আগে শিশুকে ভালভাবে খাওয়ায়ে নিতে হবে। এতে শিশু শান্তশিষ্ট থাকবে। তখন আপনি তার কাছে থেকে বেস্ট শটটা বের করে নিতে পারবেন। অথবা, বেবি সকালে ঘুম থেকে উঠার পরপরই ফটোসেশনটা সেরে ফেলা।
এই সময় ছাড়া দিনের অন্যান্য সময় শিশুরা অনেক চঞ্চল থাকে; দৌড়াদৌড়ি করে থাকে। “ছবিতে যেমন দেখা যায়, গুটিসুটি মেরে একটা বেবি সেজেগুজে শুয়ে আছে” – যেমন ছবি প্রতিটি বাবা-মা পছন্দ করেন; তেমন ছবি পেতে এই সময়টাই বেস্ট সময়।
টিপ ৭. কিশোরদের ছবি তোলা
সবে কৌশরে থেকে বেড়ে উঠছে, এমন শিশুদের ছবি নেয়া বেশ মজার, কিন্তু, বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ। এদের সাথে ফটোশুটের ছোট ছোট সেশনে শুটিং এর কাজ শেষ করুন। আর, সেশনটাতে খেলা ও মজাদার কিছু রাখতে হবে, যাতে তাদের মনযোগ সেদিকে আটকে রেখে কাজ সেরে ফেলা যায়।
আপনার কাজ হবে, শিশুদেরকে আপনার সাথে এনগেজ করে ফেলা। তাকে বা তাদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন, “আচ্ছা, দেখ তো ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে তোমার ছবি দেখা যাচ্ছে কি না?” লেন্সে তাকানো অবস্থায় শট নিলে ছবিতে আই-কন্টাক্ট পাবেন।
অন্য টেকনিক নিতে পারেন। শিশুদের দিকে না তাকিয়ে বা তাদের দিকে ক্যামেরা তাদের ফেসের দিকে ও লেভেলে না নিয়ে, অনেক ক্যান্ডিডভাবে, ওয়াড-অ্যাঙ্গেল লেন্স থেকে শট নিতে পারেন।
ক্যামেরার সাটার সাউন্ডের সাথে তারা পরিচিত হয়ে গেলে ফটোশুটে সুবিধা পাবেন। শিশুদেরকে বলুন, ছবি তুলবার সময় তারা যাতে ক্যামেরার দিকে না তাকায়, বা হাসি দেয়। জাস্ট, ফটোশুটে ভ্যারিয়েশন আনা!
শিশুরা যখন খেলনা দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পূর্ণ মনযোগ দিয়ে একটু স্থির থাকবে, তখন আপনি হয়ে উঠবেন সেই রকম ব্যস্ত। বার্স্ট মুডে একাধিক শট নিবেন। এ সময় তাদের সাথে ফ্রেন্ডলি আলাপ-চারিতায় মেতে উঠুন; তাদেরকে কিছু শট এলসিডি স্ক্রীনে দেখান, যাতে তারা আপনার সাথে ফটো সেশনে সহযোগী (involved) হয়ে উঠতে পারেন।
টিপ ৮. বার্স্ট (Burst) মুডে শুট করা
বেবিদের পোট্রেট হোক, আর গ্রুপ পোট্রেট হোক, ক্যামেরার বার্স্ট সুটিং এর সর্বোচ্চ ড্রাইভ মুড ব্যবহার করুন। রাইফেলের মত অনবরত ট্রিগার চাপার মত ক্যামেরার সাটার না চেপে, বরং সর্বোচ্চ বার্স্ট মুড ব্যবহারে আপনি সাবজেক্টের বিভিন্ন মোমেন্টের বিভিন্ন এক্সপ্রেশনের একাধিক শট নেওয়া নিশ্চিত করতে পারবেন।একাধিক শট থেকে আপনি গ্রুপ পোট্রেট এমন একটা ফ্রেম বা ছবি পেয়ে যাবেন, যেখানে সবার চোখ খোলা আছে, হাসি-হাসি চেহারা আছে।
বার্স্ট মুড থেকে আপনি যদি এমন পারফেক্ট ছবি নাও পান, তবে একাধিক শট থেকে পোস্ট প্রসেসিং এ দুই বা ততোধিক শট নিয়ে কাজ করে একটা পারফেক্ট ছবি বের করে আনতে পারবেন।
টিপ ৯. গ্রুপ পোট্রেটের পোজ
গ্রুপ পোট্রেট তুলবার সময় প্রথমেই গ্রুপের লম্বা ব্যক্তিদেরকে পিছনের দিকে নিয়ে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কম লম্বা ব্যক্তিদেরকে সামনের সারিতে নিয়ে আসবেন।
এবারের বিশেষ করে সামনের সারিতে যারা আছেন, তাদের সকলের পরিধেয় বস্ত্রের পরিপাটি থাকার বিষয়ে নজর দিন। সাবজেক্টের উচ্চতা অনুযায়ী সাজানোর মত তাদের পোশাকের রঙের ম্যাচিং করারও কম গুরুত্বপূর্ণ হয়; কারণ শট শেষ করার পর ফ্রেমে এই জিনিষটাই বেশী দৃষ্টিকটূ হয়ে দেখা যেতে পারে।
গ্রুপ পোট্রেটে সবার ছবি পরিষ্কার হওয়া চাই। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স ব্যবহার করলে অ্যাপারচার অন্ততপক্ষে f/8 রাখুন। কিন্তু, ইনডোরে গ্রুপ ছবি তুলতে গেলে f/8 অ্যাপারচার রাখলে স্বাভাবিকভাবেই সাটার স্পীড কমে যাব। এ সময় ISO বাড়িয়ে সাটার স্পীড ন্যূনপক্ষে 1/80sec রাখার চেষ্টা করুন। স্টেডি হ্যান্ড হলে এই সাটার স্পীডেও পিন শার্প ছবি পাওয়া সম্ভব। যদি ট্রাইপডে শট না নিয়ে হ্যান্ডহেল্ড স্ন্যাপ নিয়ে থাকে, তবে সাটার স্পীড এর নিচে নামালে হাতের কম্পন থেকে ছবি ব্লার হয়ে যাবে।
যদি ISO বাড়ালে ছবিতে দেশী নয়েজ চলে আসে, আবার সাটার স্পীডও তেমন বাড়ানো যাচ্ছে না, তবে পিন-শার্প ছবি পেতে একটা ট্রিক করা যেতে। সবাইকে এক লাইনে দাঁড়িয়ে যেতে বলুন। এতে অ্যাপারচার কমালে সাটার স্পীড বা ISO সুবিধামত কম-বেশী করে শট নেয়া শেষ করুন। সাবজেক্ট এক লাইনে দাঁড়ানোর কারণে অ্যাপারচার কম থাকলেও ডেপথ অব ফিল্ড সমস্যা করবে না।
টিপ ১০. ফ্যামিলি ফটো পোজিং আইডিয়া
আপনার এমন একটা গ্রুপ ফ্যামিলি পোট্রেটের কথা চিন্তা করেন, যা দেখে ফ্যামিলির বিভিন্ন সদস্যদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা যায়।
তাহলে, গ্রুপ ফ্যামিলি ফটোগ্রাফি কিভাবে করব?
এ ক্ষেত্রে সহজ আইডিয়া হল পরিবারের পিতা, বা মাতা, বা ইয়াংস্টারকে মূল সাবজেক্ট হিসাবে ফোকাস করা যেতে পারে। পরিবারের বাকি সদস্যদেরকে তার চতুর্দিকে দাঁড় করিয়ে আপনি একটা গ্রুপ ফ্যামিলি পোট্রেটে মূল ফোকাস পয়েন্ট পেতে পারেন।
আর, বড় আকারের ফ্যামিলি গ্রুপ ফটোর জন্য, আসবাবপত্র ব্যবহার করা যেতে পারে – এটা ঘরের মধ্যে সোফাও হতে পারে, বা আউটডোরে দরজাও হতে পারে। শিশুকে মেঝেতে বা মাটিতে বসিয়ে দেন এবং বড়দেরকে শিশুটির পিছনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন।
টিপ ১১. মোমবাতির আলোতে পোট্রেট
মোমবাতির আলোতে ছবি তুলবার সময় ISO কে ১৬০০ বা তার চেয়েও বেশী রাখার প্রয়োজন পড়তে পারে; সেই সাথে লাগবে বড় অ্যাপারচার। এমন আলোতে হাতের কম্পন থেকে রক্ষা পেতে, বা মডেল বা ক্যান্ডেলের আলোর শিখাকে ফ্রিজ করতে এমন সেটিং ছাড়া এ ধরনের শট নেয়া সম্ভব হবে না।
ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বন্ধ অফ রেখে ম্যানুয়াল এক্সপোজার মুড (M) ব্যবহার করুন। মোম বাতি জ্বালানো অবস্থায় ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিন। এবার সাবজেক্টের মুখে ক্যামেরা তাক করে এক্সপোজার রিডিং নিন।
মোমবাতির আলোয় প্রোট্রেট শ্যুট করতে একাধিক মোমবাতি ব্যবহার করুন। এতে আলোর পরিমাব বেশি পাওয়ার পাশাপাশি আলোর ঔজ্জ্বল্য সাবজেক্টের মুখে মোলায়েম শ্যাডো তৈরী করবে।
0 Comments